গ্রাম্য বাংলায় কৃষ্টি লোক সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখা এবং নবীন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার লক্ষ্যে কাজ করে চলেছে সংস্কার ভারতী-Sabuj Tripura

 

সবুজ ত্রিপুরা

১১ জুন

শানিবার

তেলিয়ামুড়া প্রতিনিধিঃ গ্রাম্য বাংলায় কৃষ্টি লোক সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখা এবং নবীন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার লক্ষ্যে কাজ করে চলেছে সংস্কার ভারতী। ত্রিপুরা রাজ্যের তেলিয়ামুড়া আর ডি ব্লকের মধ্য কৃষ্ণপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের সাজিয়ে 

তোলা হচ্ছে আলপনা গ্রাম। বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় হারিয়ে যাচ্ছে পৌরাণিক কৃষ্টি ও লোক সংস্কৃতি। নতুন প্রজন্মের কাছে গ্রাম্য বাংলা পরিবেশ দিনের পর দিন অচেনা হয়ে যাচ্ছে। হারিয়ে যাচ্ছে লোক সংস্কৃতি। তবে বলা বাহুল্য, লোকসম্প্রদায়ের ধর্মীয় ও সামাজিক বিশ্বাস ও আচার-আচরণ, জীবন-যাপন প্রণালী, চিত্তবিনোদনের উপায় ইত্যাদির ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠেছে সংস্কৃতি। দীর্ঘকাল ধরে গড়ে ওঠা এই সংস্কৃতি তাদের গ্রাম্য বাংলার মানুষদের প্রকৃত পরিচয় বহন করে। গ্রামের বিশাল জনগোষ্ঠী নিজস্ব জীবন প্রণালীর মাধ্যমে শতকের পর শতক ধরে যে বহুমুখী ও বিচিত্রধর্মী সংস্কৃতি গড়ে তুলেছে।তা-ই বাংলার লোকসংস্কৃতি নামে অভিহিত।

                                            হোয়াটসঅ্যাপে খবর পেতে এখানে ক্লিক করুন

গ্রাম্য বাংলার গ্রামবাসীরা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সুযোগ পায় না। তারা পূর্বপুরুষদের নিকট থেকে উৎপাদন, যানবাহন, যন্ত্রপাতি, পোশাক-পরিচ্ছদ, খাদ্যদ্রব্য, ধর্মকর্ম, চিত্তবিনোদন ইত্যাদি সম্পর্কে প্রত্যক্ষভাবে যে অভিজ্ঞতা অর্জন করে, তাকে অবলম্বন করেই জীবনযাত্রা নির্বাহ করে। সরলতা, সজীবতা ও অকৃত্রিমতা গ্রাম্য বাংলার লোকসংস্কৃতির। মঞ্চে যাত্রাভিনয় ও গান প্রাকৃতিক পরিবেশে বসবাসরত অক্ষরজ্ঞানহীন ও ঐতিহ্যানুসারী বৃহত্তর গ্রামীণ জনসমষ্টিকে ‘লোক’ বলে অভিহিত করা হয়েছে। আর এই লোক-মানসিকতার অভিন্ন গতি-প্রকৃতি সম্বন্ধে ধারণা করা যায়। বাংলার কৃষক ফসল তোলার সময় এক গোছা ধান মাঠ থেকে এনে ঘরের চালে ঝুলিয়ে রাখে। একে বলা হয় ‘লক্ষ্মীর ছড়’। কিন্তু বিশ্বের নানা দেশের কৃষকসমাজেও একই প্রথা চালু আছে; কোথাও তা ‘শস্যরাণী’, কোথাও ‘শস্যপুতুল’, কোথাও বা ‘শস্যমাতা’ নামে অভিহিত। 

লোকসংস্কৃতির অজস্র উপাদানের রূপ-প্রকৃতির বিচার করে একে চারটি প্রধান ধারায় ভাগ করা হয়: বস্ত্তগত , মানসজাত , অনুষ্ঠানমূলক  এবং প্রদর্শনমূলক  লোকসমাজ জীবনধারণের জন্য যেসব দ্রব্য ব্যবহার করে সেসব বস্ত্তগত সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত,।বাড়ি-ঘর, দালান-কোঠা, আসবাবপত্র, তৈজসপত্র, যানবাহন, সকল পেশার যন্ত্রপাতি, কুটিরশিল্প, সৌখিন দ্রব্য, পোশাক-পরিচ্ছদ, খাদ্যদ্রব্য ইত্যাদি। এর প্রত্যেকটির আবার বহুবিধ প্রকারভেদ আছে। যেমন কৃষক প্রায় সব ধরনের ফসল উৎপাদন করে,  তাঁতি সব ধরণের বস্ত্র,  কুমার সব ধরনের হাঁড়ি-পাতিল, ছুতার কাঠের যাবতীয় আসবাবপত্র,  কামার লোহার বিবিধ যন্ত্রপাতি ইত্যাদি নির্মাণ করে। ধোপা,  নাপিত, সোনারু, কাঁসারু,  শাঁখারি, ময়রা,চর্মকার, ঘরামি,  জেলে, কাহার প্রভৃতি বৃত্তিধারী শ্রমজীবী মানুষ পেশাগত কাজে নানারকম হাতিয়ার ব্যবহার করে। গ্রামের মানুষ জীবনধারণের প্রয়োজনীয় খাদ্য ও পণ্য নিজেরাই উৎপাদন ও বিতরণ করে।এজন্য তাদের অন্যের দ্বারস্থ হতে হয় না। পর্ণকুটিরে বসবাস গ্রামের একটি সাধারণ দৃশ্য। পাশাপাশি আবার একচালা থেকে আটচালা ঘরও নির্মিত হয়। সৌখিন ও অবস্থাসম্পন্ন ব্যক্তিরা আটচালা গৃহ নির্মাণ করে থাকে। এ ক্ষেত্রে কেবল প্রয়োজনীয়তা নয়, নান্দনিকতারও ব্যাপার আছে। বাংলার লোকসংস্কৃতি এখানে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য অর্জন করেছে।জামদানি বস্ত্রের সুনাম এখনও আছে। কুমার নির্মিত মাটির দেবদেবীর মূর্তি এখনও মৃৎশিল্পের অনন্য নিদর্শন। তারা  সখের হাঁড়ি, মনসার ঘট, লক্ষ্মীর সরা ইত্যাদি তৈরি করে অনন্য শিল্পীমনের পরিচয় দিয়েছে। ছুতার প্রাচীন কাল থেকেই কাঠের খাট-পালঙ্ক, দরজা, চৌকাঠ,  নৌকা ইত্যাদি দক্ষতার সঙ্গে নির্মাণ করে আসছে। এক সময় বাংলার ময়ূরপঙ্খি, সপ্তডিঙ্গা, চৌদ্দডিঙ্গা প্রভৃতি সমুদ্রগামী নৌকার সুনাম ছিল।  বাঁশ, বেত, কাঠ,  পাট ও শোলা দিয়ে নানারকমের নিত্য ব্যবহার্য ও সৌখিন দ্রব্য তৈরি হয়।নকশি পাটির সুনাম দীর্ঘকালের।পাটের তৈরি  নকশি শিকা আন্তর্জাতিক বাজারে সৌখিন পণ্যরূপে সমাদর পাচ্ছে।  নকশি পাখা, শিকা ইত্যাদি পল্লীর রমণীরাই তৈরি করে। পারদর্শিতা প্র লোকসংস্কৃতির অজস্র উপাদানের মধ্যে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। লোকসাহিত্যকে মাবিশ্বের প্রায় সব ধারার লোকসাহিত্যের উপাদানই বাংলা ভাষায় বিদ্যমান।  লোককাহিনী,  লোকসঙ্গীত, লোকগাথা, লোকনাট্য,  ছড়া,  ধাঁধা,  মন্ত্র, প্রবাদ-প্রবচন প্রভৃতি গদ্যে-পদ্যে রচিত মৌখিক গড়ে তোলা হয়েছে লোকসংস্কৃতি। লোকসঙ্গীতের প্রচলন আছে।  জারি,  সারি,  ভাটিয়ালি,  ভাওয়াইয়া,  মুর্শিদি, মারফতি, বাউল,  গম্ভীরা,  কীর্তন, ঘাটু, ঝুমুর, বোলান,  আলকাপ,  লেটো,  গাজন,  বারমাসি, ধামালি,  পটুয়া, সাপুড়ে, খেমটা প্রভৃতি ধারার শতশত গান আজও প্রচলিত আছে। লৌকিক ও আধ্যাত্মিক চেতনায় সমৃদ্ধ এসব গানের বাণীতে জাতির অন্তর্জীবনের পরিচয় পাওয়া যায়। কতক গানে ধর্মীয় আবেগ জড়িত আছে; তবে অধিকাংশ গানই চিত্তবিনোদনের মাধ্যম হিসেবে গীত হয়। খেমটা, পটুয়া ও সাপুড়ে গানগুলি জীবিকার সঙ্গে জড়িত।  মেয়েলি গীত, সহেলি গীত, হুদমা গীত ইত্যাদিতে নারীসমাজের কামনা-বাসনার প্রতিফলন ঘটেছে। আলপনা অংকন চিত্রকলাকে বলা যায় বস্ত্ত-আশ্রিত মানস ফসল। আলপনা,  পটচিত্র, ঘটচিত্র, দেওয়ালচিত্র, অঙ্গচিত্র প্রভৃতিতে রঙ-তুলির ব্যবহার আছে। ঘরের মেঝে, খুঁটি, দেওয়াল, কুলা, ডালা ইত্যাদিতে  আলপনা দেওয়া হয়। ব্রতপূজা উপলক্ষে ব্রতের আলপনা দেওয়ার রীতি আছে। বর্তমানে  অন্নপ্রাশন,  বিবাহ, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, এমনকি  জাতীয় দিবস পালন উপলক্ষেও পথে-প্রাঙ্গণে আলপনা দেওয়া হয়। এই আলপনা বাঙালি সংস্কৃতির নিজস্ব ধারা। পটুয়ার পটচিত্র ও পটগীত বাঙালির ধর্মীয় আবেগ-অনুভূতি থেকে উদ্ভূত। কালীঘাটের পটচিত্র এর রূপান্তরিত ও অবক্ষয়িত রূপ। অনুষ্ঠান ও প্রদর্শনমূলক লোকসংস্কৃতির মধ্যে লোকনাট্য,  যাত্রা,  নৃত্য ও খেলাধুলা প্রধান। অভিনয় ও অঙ্গক্রিয়া দ্বারা এসব রূপায়িত হয়। বাউল, গম্ভীরা প্রভৃতি গান, নাচ ও অভিনয় ত্রি-অঙ্গের সমন্বয়ে পরিবেশিত হয়। জারি গানের সঙ্গে জারি নাচ, সারি গানের সঙ্গে সারি নাচ, লাঠি খেলার সঙ্গে লাঠি নাচ, খেমটা গানের সঙ্গে খেমটা নাচ এবং ঘাটু গানের সঙ্গে ঘাটু নাচ ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এগুলি সকল শ্রেণির মানুষের চিত্তবিনোদনের উৎস। হোলির গীত, গাজীর গীত, মাগনের গীত, বিবাহের গীত, হুদমার গীত ইত্যাদি ভিন্ন ভিন্ন উপলক্ষে নিজস্ব কিছু আচারসহ পরিবেশিত হয়। কতক গান পেশাজীবী গায়েন, বয়াতি ও গীদালরা পরিবেশন করে; আর বাকিগুলি বাড়ি-ঘরে, মাঠে-ঘাটে ও খেতে-খামারে নানা শ্রেণির মানুষ কাজ করতে করতে বা কাজের অবসরে গেয়ে শ্রান্তি দূর ও আনন্দ উপভোগ করে। প্রথম জমি চাষ থেকে শুরু করে ঘরে ফসল তোলা পর্যন্ত নানা ধরনের লোকাচার আছে। এর কতগুলি প্রাকফসল, আর কতকগুলি ফসলোত্তর আচার। বৃষ্টির জন্য মেঘারাণী, হুদমা দেওয়া, বেঙ বিয়া, ফসল রক্ষার জন্য ক্ষেতবন্ধন, কাকতাড়ুয়া, গাস্বি উৎসব প্রভৃতি প্রাকফসল আচার; আর লক্ষ্মীর ছড়,  নবান্ন, মাগন প্রভৃতি ফসলোত্তর অনুষ্ঠান। 

এদিকে কথায় রয়েছে বার মাসে তের পার্বণ’ প্রবাদ দ্বারা উৎসবমুখর বাঙালি জাতির মৌলিক পরিচয় ফুটে ওঠে। হিন্দুদের ব্রতাদি আচার-অনুষ্ঠানের আধিক্যের কথা বিবেচনা করেই এরূপ প্রবাদের সৃষ্টি হয়েছে। বার, তিথি, মাস ও ঋতুভিত্তিক এসব পার্বণের উদ্ভবের পেছনে প্রাকৃতিক ও দৈব শক্তির কল্পনা আছে। শাস্ত্রীয় ধর্মের পাশাপাশি হিন্দুরা  লক্ষ্মী,  মনসা,  শীতলা, ষষ্ঠী,  ওলাদেবী, বনদুর্গা, দক্ষিণরায়, সত্যনারায়ণ, পাঁচু ঠাকুর প্রভৃতি লৌকিক ও পৌরাণিক দেবদেবীর পূজাচার পালন করে থাকে। দীর্ঘকাল একত্র বসবাসের ফলে নিম্ন শ্রেণির মুসলমানদের ওপরেও এসবের প্রভাব পড়েছে। তারা  সত্যপীর, গাজীপীর, মানিকপীর, মাদারপীর, খোয়াজ খিজির, ঘোড়াপীর, বনবিবি, ওলাবিবি, হাওয়া বিবি প্রভৃতি কাল্পনিক, লৌকিক ও ঐতিহাসিক পীর-পীরানিকে হিন্দু দেবদেবীর প্রতিপক্ষরূপে দাঁড় করিয়ে পূজা-মানত করে থাকে। এসবের পেছনে অসহায় মানুষের রোগ-ব্যাধি ও ক্ষয়-ক্ষতি থেকে রক্ষা পাওয়ার কামনা-বাসনা নিহিত রয়েছে। দুই সম্প্রদায়ের মানুষ কতক পূজা-মানত পৃথকভাবে করে, আবার কতক ক্ষেত্রে উভয়ে পরস্পরের অংশীদার হয়। সত্যনারায়ণ ও সত্যপীর, বনদুর্গা ও বনবিবি যে একই ভাবনার ভিন্ন রূপ তাতে সন্দেহ নেই। অনুরূপভাবে অসংখ্য মেলা আছে যেখানে উভয় সম্প্রদায়ের মানুষ যোগদান ও আনন্দোপভোগ করে।  এদিক থেকে বাঙালি একটি সংকর জাতি। বাংলার লোকসংস্কৃতিতেও বিভিন্ন সংস্কৃতির মিশ্রণ ঘটেছে। বিশেষ করে কৃষিকাজ ও কৃষকজীবনের ক্ষেত্রেই মিশ্রণ বেশি হয়েছে। ধর্ম, মত ও পথ নির্বিশেষে যুগযুগ ধরে বিভিন্ন বর্ণ ও পেশার মানুষের একত্র বসবাস ও পরস্পর ভাবের আদান-প্রদানের ফলে গ্রামীণ জীবনে বিরোধ অপেক্ষা ঐক্যের সুরই বেশি ধ্বনিত হয়েছে। এজন্য ভারতীয় সংস্কৃতির মতো বাংলার লোকসংস্কৃতিতেও বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের প্রতিফলন ঘটেছে এবং এর মধ্যেই বাঙালির জাতিগত পরিচয় নিহিত রয়েছে। আর সেই হারিয়ে যাওয়া লোকসংস্কৃতি সংস্কৃতি গুলিকে নবীন প্রজন্মের কাছে তুলে দেওয়ার জন্য আলপনা 

গ্রামের সাজিয়ে তোলা হচ্ছে মধ্য কৃষ্ণপুর গ্রাম পঞ্চায়েত গ্রামে। সংস্কার ভারতী সংস্থার পক্ষ থেকে কৃষ্ণপুর এলাকায় প্রায় কুড়িটি মাটির কৌঠাকে সাজিয়ে তোলা হচ্ছে গ্রাম্য বাংলার পৌরাণিক আলপনার রংতুলিতে। কচিকাঁচা শিশু থেকে শুরু করে বছর ১৫-১৬ বছরের যুবক যুবতীদের শেখানো হচ্ছে অংকন। লোকসংগীত থেকে শুরু করে গ্রাম্য বাংলার বিভিন্ন ধরনের গান শেখানো হচ্ছে গ্রাম্য শিশু থেকে যুবক যুবতীদের। গ্রাম্য নৃত্য শিখিয়ে গড়ে তোলা হচ্ছে আলপনা গ্রাম। আগামী কিছুদিনের মধ্যে আলপনা গ্রামটি জনসম্মুখে তুলে দেওয়া হবে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

Close Menu